Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিবগঞ্জ উপজেলার ইতিহাস

ইতিহাস প্রসিদ্ধ গৌড় ও প্রাচীন সভ্যতার সুতিকাগার বরেন্দ্র ভূমিরই অংশ শিবগঞ্জ উপজেলা। প্রকৃতপক্ষে শিবগঞ্জ তথা চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্বতন্ত্র কোন ইতিহাস নেই। গেŠড় ও বরেন্দ্র ভূমির প্রাচীন ইতিকথাই শিবগঞ্জ উপজেলার প্রাচীন ইতিহাস। ঐতিহাসিকদের মতে গৌড়, সারস্বত, কান্যকুজ, মিথিলা ও উৎকল এ পঞ্চ গৌড় কোন এক সময় মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমানের কিয়দংশ ও মালদহ গৌড়ের অন্তগর্ত ছিল। সুতরাং মালদহের অংশ হিসেবে শিবগঞ্জও গৌড়ের অখন্ড অংশ এতে কোন সন্দেহ নেই। পঞ্চগৌড়ের উল্লেখ সর্ব প্রথম পাওয়া যায় রজতরঙ্গিনী গ্রন্থে। পরবর্তীকালে বহু জায়গায় পঞ্চগৌড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। গৌড় ও বরেন্দ্র ভূমির ইতিহাসকেই এখানে শিবগঞ্জের ইতিহাস হিসেবে আলোচনা করা হয়েছে।

 

১। প্রাচীন ইতিহাসঃ

বরেন্দ্র ভূমি নামকরণের পেছনে একাধিক পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। ‘বর’ শব্দের অর্থ আশীর্বাদ আর এ ‘বর’ শব্দ থেকেই বরেন্দ্র নামের উৎপত্তি। রামায়ন ও মহাভারত গ্রন্থদ্বয়ে বরেন্দ্র ভূমিকে ‘পুন্ডু’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। গৌড় রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তীর অন্ত নেই। অনেকের ধারণা মগধে প্রদ্যোতন রাজারা যে সময় রাজত্ব করতেন সে সময় ভোজ নামক এক ব্যক্তি গঙ্গা পুলিণে গৌড় নগর স্থাপন করেন। তিনি অযোধ্যার অন্তর্গত গৌড়ের অধিবাসী ছিলেন। জন্মভূমির নামানুসারে স্বীয় প্রতিষ্ঠিত নগরীর তিনি নামকরণ করেন গৌড়। এ দাবি কতটা সত্য তা জানা যায়নি। তবে তা যদি সত্য হয়ে থাকে তবে গৌড় নগরী যে খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতকে নির্মিত হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর এ মতও প্রচলিত যে পুন্ডু নগরের কোন কোন অংশে গুড়ের খুব কারবার হতো বলেই চিনি বা গুড় ব্যবসায়ের নাম হতেই নাকি গৌড় নগরীর উৎপত্তি হয়। প্রাচীনকালে পশ্চিম ভারতের সাথে নদী পথে এখানকার ব্যবসা বাণিজ্য চলতো। নবাবগঞ্জের বিভিন্ন জায়গা এর কেন্দ্রভুমি ছিল। ব্যবসায় বাণিজ্যে এখানকার অধিবাসীরা খুব উন্নত ছিল। পোড়া নামে এক জাতি ছিল। তারা চিনি বা গুড় প্রস্ত্তত করার জন্য ইক্ষুর রসে তাপ দিত। পরবর্তীকালে এরা রেশমের সুতা কাটত। এদের নাম অনুসারেই পৌন্ড্রবর্দ্ধন নামের সৃষ্টি হয়। সেন বংশের রাজত্বকালে এ অঞ্চল বরেন্দ্রভুম বা বরিন্দা নামে পরিচিত হয়।

 

যদিও গৌড় রাজ্য সম্পর্কে নানা মত প্রচলিত তথাপি ও পাণিনি সূত্রে উল্লিখিত গৌড়পুর হতে আরম্ভ করে গৌড় শব্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় ভুখন্ডের দ্যোতক হিসাবে। তারপর কৌটিল্যও তার অর্থ শাস্ত্রে গৌড়, পুন্ডু, বঙ্গ এবং কামরূপের উল্লেখ  করেছেন। পাণিনির বিখ্যাত টীকাকার গীতাঞ্জলিও যেমন গৌড়ের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, সেরূপ পরিচিত ছিলেন তৃতীয় চতুর্থ শতকে বাৎসায়ন পুরাণেও এক গৌড় দেশের উল্লেখ আছে। আনুমানিক ষষ্ঠ শতকে বরাহ মিহির গৌড়ক, পৌন্ড্র, বঙ্গ, সমতট  ও তাম্রলিপ্তক নামে কয়েকটি পৃথক পৃথক জনপদের উল্লেখ করেছেন। ভাষাতেও গৌড়ীয় রীতির পরিচয় পাওয়া যায় রাজশেখরের কাব্য মীমাংসায় দন্ডীর কাব্যাদর্শে। এ সকল উল্লেখ ও প্রসঙ্গ হতে দেখা যায় যে, প্রাচীন সাহিত্যে গৌড়ের উল্লেখ অনেক জায়গাতেই রয়েছে। কিন্তু সেগুলো হতে নিঃসন্দেহে গৌড়দেশের সঠিক অবস্থিতি সম্বন্ধে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সুকঠিন। অষ্টম শতকে মুরারি অনর্থ রাঘবেঢ় উল্লিখিত গৌড় জনপদের রাজধানী চম্পা আদৌ এ দেশের সাথে সংশ্লিষ্ট কিনা সে সম্বন্ধে সন্দেহ হয়। কেউ কেউ নবাবগঞ্জের পপাই কে চম্পা বলে থাকেন। ভাগলপুরে এবং বর্ধমানের দামোদর নদের বাম তীরে চম্পা নামে নগরী ছিল। ধর্ম্মপালের সমসাময়িক খৃষ্টীয় শতকের শেষার্দ্ধে গৌড়ের রাষ্ট্রাধিকার যে বঙ্গদেশে বিস্তৃত ছিল এটি বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ আছে। গৌড় কখনও স্বতন্ত্র আবার কখনও বা রাঢ় এবং ভুরিশ্রেষ্ঠিকের অন্তর্গত বলে আখ্যাত হয়েছে। ত্রয়োদশ শতকে যশোধরের গ্রন্থে দেখা যায় যে, গৌড় ভুখন্ড কলিঙ্গ (বর্তমান উড়িষ্যা) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ত্রয়োদশ ও চতুর্দ্দশ শতকে জোনদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভবিষ্য পুরান বা ত্রিকান্ড শেষ গ্রন্থে গৌড়কে পুন্ডু বা বরেন্দ্রীয় অন্তর্গত বলে উল্লেখ করা  হয়েছে। পুন্ড্রবর্ধণে যখন যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নবাবগঞ্জেও তখন সে শাসন বিস্তৃত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে কখন থেকে এ অঞ্চল সার্বভৌম শাসনকর্তার শাসনে শাসিত হতে থাকে তার কোন সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। আর্যদের আগমন এদেশে কখন ঘটেছিল সে সম্পর্কে কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেউ কেউ অনুমান  করেন যে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার বছর আগে আর্যরা এদেশে এসেছিল। দুর্ধর্ষ আর্যরা আর্যাবত অর্থাৎ উত্তর ভারতে প্রথম দিকেই তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু চতুর্থ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাটগণ কর্তৃক বাংলাদেশে অধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বে কোন আর্যশক্তি এদেশ অধিকার করেছিল এমন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকদের মতে, গুপ্ত সম্রাটগণই ভারতে সর্বপ্রথম এক সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। গুপ্ত শাসনের পর সামন্তরাজা শশাঙ্ক এক বিরাট স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে মাহরাজাধিরাজ উপাধি লাভ করেন। তার সময়ে বাংলার সীমানা বহুদুর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তিনি সম্ভবত ৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার মৃত্যুকালে (৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে) গৌড় তার রাজ্যভুক্ত হওয়ায় নবাবগঞ্জ নামক ভু-খন্ডটি সে সময় তার রাজ্যভুক্ত হয়েছিল  এতে কোন সন্দেহ নেই। মহারাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড় রাজ্য সম্রাট হর্ষবর্ধন ও তার মিত্র কামরূপরাজ ভাষ্কর বার্মার অধীনে চলে যায়। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর (৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহিঃশক্তির বার বার আক্রমণের ফলে গৌড়ের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে শতবর্ষব্যাপী এক বিভীষিকারময় অন্ধকার যুগের সূচনা হয়। এ সময়কালকে ঐতিহাসিকগণ মাৎস্যন্যায় যুগ বলে বর্ণনা করেছেন। সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে একশ বছর সময়কাল পর্যন্ত বিস্তৃত গৌড় রাজ্যে মাৎস্যন্যায় যুগের রাজনৈতিক ও সামাজিক অনিশ্চয়তার অবসান ঘটে প্রথম পাল নৃপতি গোপালের রাজ্যজয়ের মাধ্যমে। তিনি সমগ্র রাজ্যে শান্তিও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তার বংশ প্রায় ৪০০ বছর ধরে এদেশে রাজ্ত্ব করেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ধর্মপাল (৭৭০-৮১০), দেবপাল (৮১০-৮৫০) ও রামপাল (১০৭৭-১১২০) এ বংশর কয়েকজন খ্যাতিমান নৃপতি।

 

দশম শতাব্দীর দিকে কম্বুজাম্বয়জ পরিচয় বহনকারী এক রাজবংশ গোপালের বংশধরদের বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করে। একাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পাল বংশের নবম রাজা মহীপাল ( ৯৮০-১০৩০) পাল বংশের গৌরব আংশিক উদ্ধার করেন। একাদশ শতাব্দীতে দিব্যক নামক একজন বৈর্ত বংশীয় সামন্তরাজা পালদের বিতাড়িত করে গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করেন। তার ভ্রাতা রোদক ওরাদকের পরে তার পুত্র ভীম রাজা হন। রামপাল পরবর্তীতে ভীমকে পরাজিত ও নিহত  করে পিতৃরাজ্য পুনরাধিকার করেন। রামপালের পরই পালরাজ শক্তি অত্যন্তদূর্বল হয়ে পড়ে এবং শেষ পাল নৃপতি মদনপালের সময়ে (১১৪০-৫৫) সেনরা গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করেন। কর্ণাটক থেকে আগত রাঢ় অঞ্চলের বসবাসকারী সামন্ত সেনের পৌত্র ও হেমন্তসেনের পুত্র বিজয় সেন (১০৯৭-১১৫৮) ছিলেন সেন বংশের প্রথম নৃপতি। বিজয় সেনের মৃত্যুর পর তার পুত্র বল্লাল সেন বঙ্গের সিংহাসনে আরোহণ করেন। নবাবগঞ্জে এখনও তার অসংখ্য কীর্তির স্বাক্ষর রয়েছে। তন্মধ্যে শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত বালুয়াদীঘি ও গোমস্তাপুর উপজেলার মকরমপুর ঘাটে অবস্থিত শ্মশান বাড়ি অন্যতম। তার পুত্র লক্ষ্মণ সেন (১১৭৯-১২০৫) এর সময়ে বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে।

 

২। মধ্য যুগের ইতিহাসঃমুসলিম শাসন আমলের শুরু থেকেই মূলত এ অঞ্চলের মধ্যযুগীয় ইতিহাস রচিত হয়েছে। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে গৌড় রাজ্য (লখনৌতি) অধিকার করেন। সে সময় গৌড়ের শাসনকর্তা ছিলেন সেন বংশের বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেন। তিনি তখন নদীয়ায় অবস্থান করছিলেন। কোন প্রতিরোধ না করে নদীপথে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। উত্তর ও উত্তর পশ্চিম বাংলা বখতিয়ার অধিকার করেন এবং লক্ষণাবতীকে (গৌড়) কেন্দ্র করে বাংলায় মুসলিম সাম্রাজের প্রতিষ্ঠা করেন। বখতিয়ার খলজীর পরবর্তী সময়ে ইয়াজউদ্দীন মহম্মদ ই শিরাণ (১২০৫-০৮), আলাউদ্দীন আলী মার্দন (১২০৮-১১), হুসাম উদ্দীন গিয়াস উদ্দীন ইওয়াজ (১২১১-২৬), নাসিরুদ্দীন মাহমুদ (১২২৬-২৯), ইজুল মুলক আশাউদ্দিন জানি (১২২৯), সাইফউদ্দীন আইবেক (১২২৯-৩৩) ও ইয়াজ উদ্দীন তুঘরিল তুঘান খান (১২৩৩-৪৪) গৌড় শাসন করেন। তিনি ছিলেন দিল্লীর গিয়াস উদ্দীন বলবনের প্রতিনিধি। পরে বিদ্রোহী হলে বলবন তাকে পরাজিত ও নিহত করে নিজ পুত্র নাসির উদ্দীন বুঘরা খানকে গৌড়ের সিংহাসনে বসান। পরবর্তীতে সুলতান শামসউদ্দীন ফিরোজ শাহ, জালাল উদ্দীন মাহমুদ শাহ, শিহাব উদ্দীন বুঘরা শাহ, গিয়াস উদ্দীন বাহাদুর শাহ, নাসির উদ্দীন ইব্রাহিম এবং শিহাব উদ্দীন ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লীর অধিনে থেকে গৌড় শাসন করেন। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে (১৩৩৮) সোনারগাঁয়ে সুলতান ফখরউদ্দীন মোবারক শাহ (১৩৩৮-৪৯) দিল্লীর অধীনতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে বাংলার স্বাধীন সুলতান রূপে রাজতব করতে থাকেন। সুলতান ফখরউদ্দীনের পর তার পুত্র শামস উদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪৯-৫৮) তার পুত্র সিকান্দার শাহ (১৩৫৮-৯০) নামধারণ করে গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। জালাল উদ্দীনের মৃত্যুর পর তার পুত্র শামস উদ্দীন আহমদ শাহ (১৪৩১-৪২) গৌড় শাসন করেন। তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হলে ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতান আসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৪২-৫৯) গৌড়ের সিংহাসনে আরোহন করেন। ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই রাজবংশের নৃপতিগণ গৌড় শাসন করেন। এ বংশের রাজত্বের শেষ দিকে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং পর  পর কয়েকজন হাবসী সুলতান কয়েক বছর রাজত্ব করেন।

     

      ১৪৮৭ থেকে ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার পর ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করেন এবং দক্ষতার সঙ্গে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তার গৌরবময় রাজত্বকালে ছোট সোনা মসজিদ নির্মিত হয়। প্রজাদরদী নৃপতি আলাউদ্দীন হোসেন শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র নাসির উদ্দীন নসরৎ শাহের রাজত্বকালে (১৫১৯-৩২) শের শাহ এদেশ অধিকার করেন। শের শাহের সংক্ষিপ্ত রাজত্বকালের (১৫৩৭-৪৫) পর মোঘলশক্তি শের শাহের স্বগোত্রীয় পাঠান আমিরদের মধ্যে বাংলাদেশের অধিকার নিয়ে লড়াই চলে দীর্ঘদিন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে বাংলাদেশে মোঘল শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। দিল্লী ও আগ্রাতে অবস্থানরত বিভিন্ন মোঘল সম্রাটের রাজত্বকালে তাদের নিযুক্ত সুবাদারগণ বাংলাদেশ শাসন করেন।

 

এসব সুবাদারদের মধ্যে শাহাজাদা সুজার (১৬৩১-৫৯) বেশ কিছু কীর্তি শিবগঞ্জে আজও রয়েছে। তিনি ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চল শাসন করেন। তার কাছারী বাড়ির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে শিবগঞ্জ উপজেলার ফিরোজপুরে। তার সময়ে গৌড়ের পূর্বাঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রঃ) এখানে আসেন। সুলতান তাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানান এবং তার হাতে বায়াত হন। পরে তিনি গৌড় নগরীর উপকন্ঠে শিবগঞ্জ উপজেলায় ফিরোজপুরে স্থায়ীভাবে আস্তানা স্থাপন করেন। কথিত আছে যে, শাহ সুজা যখন ফিরোজপুরে তার মুর্শিদ শাহ নেয়ামতুল্লাহকে দেখতে আসতেন তখন তার অস্থায়ী নির্বাসের জন্য অট্টালিকাটি নির্মিত হয়। সম্রাট মহিউদ্দীন আলমগীর আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭) এই কামেল আওলিয়াকে ৫০০০ (পাচঁ হাজার) টাকা আয়ের সম্পত্তি মদদ-ই-মাস স্বরূপ তার ও তার বংশাবলীর ভরণপোষণের জন্য দান করেন। হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রঃ)- প্রায় ৩৩ বছর ফিরোজপুরে বসবাস করেন।

 

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা গৌড় নগরীর অবক্ষয়ের প্রধান কারণ ছিল বলে মনে করা হয়। যখন চট্টগ্রামকে নিয়ে আরাকান, ত্রিপুরা ও বাংলা এবং পরে পর্তুগিজ ভাগ্যান্বেষীদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়, তখন শেরশাহ কর্তৃক গৌড় বিজয় ও লুন্ঠনের ফলে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ হতে ভাগীরথী অঞ্চল বিশেষ করে এর উপরের অংশ স্থিতিহীন হয়ে পড়ে। গৌড়ে তিন মাস স্থায়ী স্বাচ্ছন্দময় জীবনযাপন কালে হুমায়ুন এ নগরীকে জান্নাতাবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ সময়ে হোসেনশাহী বংশের বিলুপ্তি ঘটে। যখন পর্তুগিজ ব্যবসায়ীগণ প্রথমে সপ্তগ্রামে পরে হুগলিতে বসতি স্থাপন করে, তখন তাদের দুঃসাহসী স্বদেশীয়রা উপকুলীয় অঞ্চলে লুটপাট করেছিল। এতে বাণিজ্যপথ বিঘ্নিত হয়। মুগল পাঠানদের লড়াইয়ের অব্যবহিত পরে আসে চূড়ান্তআক্রমণ। এতে কার্যত বাংলার উত্তরাংশ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এ ধরনে অবিরাম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির ফলে জনবহুল শহরের রক্ষণাবেক্ষণ অবহেলিত হয়। ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ভিনসেন্ট ল্য গৌড় নগরীর অংশসমূহে জলাবদ্ধতা দেখেছেন। এতে বোঝা যায় যে, খালসমূহ যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় নি। এর ফলে প্লেগ রোগ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিদিন তিনশত লোকের মৃত্যু ঘটে। এ রোগে মুনিম খানও প্রাণ হারান। সম্ভবত মহানন্দা ও গঙ্গার সঙ্গে নগরীর খালসমূহের মাধ্যমে যে সংযোগ ছিল তা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। গঙ্গা নদীর গতিপথ পশ্চিমদিকে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কারণে ও তা ঘটতে পারে । ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে পর্তুগিজদের দ্বারা  মালাক্কা দখল হওয়ায় গৌড় সম্পগ্রাম এবং দক্ষিণ পূর্ব এলাকায় মুসলমান ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহণে সমস্যা সৃষ্টি হয়। যুগপৎ নৈরাজ্য এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে গৌড় নগরীর বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বিলীন হতে থাকে। মুগল বিজয় এবং নদীর পূর্বতীরে তান্ডা থেকে রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ায় একটি নতুন তাৎপর্যময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যা গৌড় নগরীর পতনকে নিশ্চিত করে।

 

উনিশ শতকের শেষদিক হতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী লেখাসমূহ স্বাধীন বাংলার প্রতীক হিসেবে গৌড়ের উপর নিবদ্ধ ছিল। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রমাজপ্রসাদ চন্দ, রাখালদাস বন্দো্যাপাধ্যায়, রজনীকান্তচক্রবর্তী, চারুচন্দ মিত্র এবং অন্যান্যরা প্রাক মুগল রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন। এরা আঞ্চলিক ইতিহাসের অংশ হিসেবে নয় বরং বাংলার স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে গৌড়ের উপর তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন । কিন্তু অল্প কয়েকটি ব্যতীত নগরের ধ্বংসাবশেষসমূহ এবং নগরটি ইতিহাসবিদদের দৃষ্টির বাইরেই ছিল। ফলে হুমায়ুনের জান্নাতাবাদ একটি হারানো ও বিস্মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় মোঘল শক্তি হীনবল হয়ে পড়লে বাংলার সুবাদারগণ নামেমাত্র মোঘল আধিপত্য পেলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তারা স্বাধীনতাভাবেই রাজত্ব করছিলেন। সে সময় নবাব আলীবর্দী খান (১৭৪০-৫৬) নবাব সরফরাজ খানকে (১৭৩৯-৪০) পরাজিত ও সিংহাসানচ্যুত করে বাংলা বিহার উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহন করেন। আলীবর্দী খার সময়েই এ এলাকার নাম নবাবগঞ্জ হয়।

 

৩। সাম্প্রতিক ইতিহাসঃশিবগঞ্জ উপজেলায় সাম্প্রতিক ইতিহাস আলোচনায় বৃটিশ শাসন আমল ও পাকিস্তানী শাসন আমল সহ উল্লেযোগ্য ঘটনাবলীই মূলত আলোচনা করা হয়েছে। এ অঞ্চলের ইতিহাস খুব প্রাচীন হলেও নবাবগঞ্জ তথা শিবগঞ্জের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। নবাবগঞ্জ প্রাক ব্রিটিশ যুগ পর্যন্ত নবাবদের বিহারভূমি হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে লোকালয় গড়ে উঠলে স্বাভাবিকভাবে সেখানে নানা পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তবে একথা সত্যি যে, নবাবগঞ্জ শহরে থানা স্থাপন খুব বেশী দিনের কথা নয়। পূর্ণিয়া ও দিনাজপুর জেলা ভেঙ্গে মালদহ জেলা গঠিত হয় ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একে কোন কালেক্টরের অধীন দেয়া হয়নি। Mr. Ravan Show মালদহ জেলার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর নিযুক্ত হন। এ সময় শিবগঞ্জ ও কালিয়াচক থানা দুটি অপরাধপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি ছিল। শিবগঞ্জে অবস্থিত তরতীপুর  সে সময় বড় নদী বন্দর ছিল। লালগোলা ঘাট থেকে মহানন্দা নদীর উপর দিয়ে শিবগঞ্জ ভোলাহাট, ইংরেজ বাজার হয়ে রাজমহল পর্যন্ত এবং পদ্মার ওপর দিয়ে মনিহার ঘাট, সাহেবগঞ্জ মুঙ্গের ভাগলপুর প্রভৃতি স্থান পর্যন্ত স্টিমার যাতায়াত করতো। কালক্রমে নদী ভরাট হয়ে স্টিমার চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।। শিবগঞ্জ থেকে নদী দূরে সরে যাওয়ায় জনগণের অসুবিধা বেড়ে যায়। এসব কারণে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে মুন্সেফ চৌকি শিবগঞ্জ থেকে নবাবগঞ্জে স্থানান্তরিত হয়।। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চল রাজশাহীর জেলার অর্ন্তভূক্ত ছিল। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্তবিহার  ভাগলপুরের অন্তর্গত ছিল। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশসহ এ অঞ্চলটি আবারও রাজশাহী বিভাগের অন্তর্ভূক্ত করা হয় এবং তা মালদহ জেলাধীন থাকে।

 

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের সময় র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে নবাবগঞ্জ ও তার পার্শ্ববর্তী শিবগঞ্জ, নাচোল, ভোলাহাট ও গোমস্তাপুর থানাকে মালদহ থেকে বিছিন্ন করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী জেলার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। শাসন ব্যবস্থার সুবিধার্থে ১৯৪৮ খিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর রাজশাহী জেলার একটি থানা ও দিনাজপুরের অন্তর্ভূক্ত পোরশা থানা নিয়ে একটি নতুন মহকুমার সৃষ্টি হয় এবং নবাবগঞ্জ শহরে মহকুমা সদর দফতর স্থাপিত হয়। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপতি লেঃ জেঃ (অবঃ) হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ প্রশাসনকে জনগণের দোর গোড়ায় পৌছে দেয়ার লক্ষ্যে থানাগুলোকে উপজেলা এবং মহুকুমাকে জেলায় রূপান্তরিত করেন। এ পদক্ষেপের কারণে নবাবগঞ্জের ৫টি থানা শিবগঞ্জ, নাচোল, ভোলাহাট, গোমস্তাপুর ও নাবগঞ্জ সদর উপজেলায় উন্নীত হয়।